বরিশাল প্রতিনিধি :
ব্যবসা-বানিজ্যে জড়িয়ে পড়ছেন বরিশাল শের-ই বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালের চিকিৎসক থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
হাসপাতাল ক্যাম্পাসের একশ গজের মধ্যেই গড়ে ওঠা বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের মালিক হয়েছেন তাঁরা। এ ক্ষেত্রে তাঁরা নেননি সরকারের অনুমোদন। যা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
এ বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সু-দৃষ্টি না থাকলেও ভাবিয়ে তুলেছে সরকারের নীতি নির্ধারকদের। সম্প্রতি যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যবসায়ী জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এমনকি এ বিষয়ে খুব শিঘ্রই ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ থেকে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কিছু কিছু সরকারি কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা সরকারের অনুমোদন ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, যা সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘বিধিমালার ১৭ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোন সরকারি কর্মচারী সরকারের অনুমোদন ছাড়া, সরকারি কাজ ছাড়া অন্য কোন ব্যবসায় জড়িত হতে পারবে না। অন্য কোন চাকরি বা কাজ গ্রহণ করতে পারবেন না। পরিবারের সদস্য অর্থাৎ স্ত্রী-সন্তানও ব্যবসা করতে পারবেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘শেবাচিম হাসপাতালের অধিকাংশ চিকিৎসক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারের এই আইন লঙ্ঘন করছেন।
এ তালিকায় রয়েছে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নামও। যারা সরকারি কর্মচারী বিধিমালা লঙ্ঘন করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী জাড়াচ্ছেন। যদিও তাঁরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সারাসরি নিজেদের নাম যুক্ত না করে স্ত্রী-সন্তান কিংবা ভাইসহ স্বজনদের নাম ব্যবহার করছেন।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত এমন কিছু চিকিৎসক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম পরিচয় এসেছে সাংবাদিকদের কাছে। জারা হাসপাতালে চাকরি করে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ক্লিনিকের মালিক হয়েছেন। নিজেদের ব্যবসার প্রসার ঘটনাতে এরা হাসপাতালে আসা রোগীদের তাদের নিজ নিজ মালিকানাধিন প্রতিষ্ঠানে পাঠাচ্ছেন পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য।
হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ‘এ হাসপাতালের শিশু বিভাগের অধ্যাপক ডা. এম.আর তালুকদার মুজিব, কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবির, সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. জহুরুল হক মানিক, গাইনী বিভাগের ডা. আখতারি ইসলাম, আরটি পিসি আর ল্যাবের ইনচার্জ সহকারী অধ্যাপক ডা. এ.কে.এম আকবর কবিরসহ বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট ক্লিনিকের ব্যবসার সাথে জড়িত।
এরা বাংলা বাজার পলি ক্লিনিক, রূপাতলী আব্দুল্লাহ হার্ট সেন্টার, কালীবাড়ি রোড মমতা কিডনি ডায়ালসিস সেন্টার, শেবাচিম হাসপাতালের সামনে আবিদ ইসলামিয়া মেডিকেল সার্ভিস এবং ইসলামিয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে ব্যবসা করছেন। যদিও এরা প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেননি।
এছাড়া হাসপাতালের অধিকাংশ তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারীরাও জড়িয়েছেন বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং ক্লিনিক ব্যবসায়।
এর মধ্যে হাসপাতালের নাক-কান-গলা বহিঃবিভাগের এমএলএসএস তরিকুল ইসলাম হাসপাতালের সামনে তিনটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকানা অংশিদার। তিনি তার স্ত্রীর নামে ডক্টর্স, সেইভ এবং দি বরিশাল নামক তিনটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক। মেডিসিন বহিঃবিভাগে এমএলএসএস রুহুল আমিন লিখন ডক্টর্স ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অংশিদার।
পুরুষ চার্জারি ওয়ার্ডে কর্মরত তরিকুল ইসলাম রনি এবং সাইফুল ইসলাম দি বরিশাল নামক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অংশিদার। সেইভ ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অংশিদার হয়েছেন প্রশাসনিক বিভাগে হিসাব শাখার শাহাদাৎ হোসেন সোহাগ, প্যাথালজি বিভাগের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মজিবর রহমান, গাইনী বহিঃবিভাগের এমএলএসএস নাসিমা বেগম, জরুরী বিভাগের ট্রলি চালক হায়দার, উপ-পরিচালক কার্যালয়ের পিওন (বরখাস্তকৃত) কালামও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অংশিদার।
প্যাথালজি বিভাগের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মাইদুল ইসলাম সুমন এবং আইএইচটি’র প্রভাষক তাহের সুমনও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে জড়িত। প্রশাসনিক বিভাগের কেরানী শহীদুল ইসলাম ডক্টর্স, সার্জারী ওয়ার্ডের আয়শা সেইভ ডিজিটাল এমনকি পরিচালকের গাড়ি চালকও নিজেও দি বরিশাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অংশিদার।
সূত্র জানিয়েছে, এদের বাইরেও আরও অনেকেই রয়েছেন, যারা সরকারি চাকরির বিধি লঙ্ঘন করে নিজেদের স্ত্রী-সন্তান এবং স্বজনদের নাম ব্যবহার করে বেসরকারি ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসা করছেন। এরা সবাই দীর্ঘদিন ধরে একই প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুবাধে স্থানীয়ভাবে ব্যবসায় জড়িয়েছেন।
হাসপাতালে রোষ্টার দুর্নীতির কারণে একই স্থানে দীর্ঘদিন যাবত দায়িত্ব পালনের সুবাধে নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে রোগী পাঠিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কমিশন বানিজ্যসহ নানা অপরাধ এবং অনিয়মে জড়িয়েছেন।
এসব বিষয়ে কথা হয় হাসপাতাল পরিচালক ডা. এইচ.এম সাইফুল ইসলাম এর সাথে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে ব্যবসা-বানিজ্যের সুযোগ রয়েছে কিনা’ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি আমার সঠিকভাবে জানা নেই।
তবে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে জড়িত আছেন এমন কোন কর্মচারীর নাম-পরিচয় নিশ্চিত করে জানা গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
একই স্থানে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালেনের সুযোগ আছে কি? এমন প্রশ্নের উত্তরে পরিচালক বলেন, ‘একজন কর্মচারী এক স্থানে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করলে সে বিভিন্ন অনিয়ম এবং অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
এ কারণেই আমি একজন কর্মচারী যাতে একই স্থানে সর্বোচ্চ তিন মাসের বেশি ডিউটি করতে না পারে সে বিষয়ে ওয়ার্ড মাষ্টারদের নির্দেশনা দিয়েছি।
প্রতি তিন মাস অন্তর রোটেশন অনুযায়ী তাদের রোষ্টার করতে বলা হয়েছে। তবে করোনাকালিন সময়ে এই নিয়মের কিছু ব্যস্তয় ঘটেছে স্বীকার করে পরিচালক বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি।
খুব শিঘ্রই রোষ্টার পরিবর্তন করে একই স্থানে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করা কর্মচারীদের রোটেশন অনুযায়ী স্থানান্তর করা হবে।
এদিকে, দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ‘যারা সরকারি চাকরি করেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে পড়ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
কিন্তু এখানে সর্ষের মধ্যেই ভূত ঢুকেছে। কেননা শেবাচিম হাসপাতাল পরিচালক ডা. এইচ.এম সাইফুল ইসলাম নিজেই বেসরকারি ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবসার সাথে জড়িত। নগরীর সিএন্ডবি রোডে নিরূপন ক্লিনিক নামক একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি।
এ হাসপাতালে পরিচালক হিসেবে যোগদানের পূর্বে থেকেই তিনি প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন। যে কারণে হাসপাতালের অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের এমন অনিয়মের বিষয়ে তিনি কতটুকু গুরুত্ব দিবেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সচেতন মহল।