স্টাফ রিপোর্টার :
করোনাভাইরাসের প্রকোপ কোনোভাবেই কমছে না। বাড়ছে শনাক্তের সংখ্যা। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দেশে গত এক দিনে সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৩৬৪ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। মৃত্যু হয়েছে ১০৪ জনের
সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে গত ৭ এপ্রিল ৭ হাজার ৬২৬ জন নতুন রোগী শনাক্তের খবর এসেছিল। দেশে মহামারি শুরুর পর থেকে সেটাই ছিল এক দিনে শনাক্ত রোগীর সর্বোচ্চ সংখ্যা। আগে জানানো হয়েছিল ৭ হাজার পর্যন্ত করোনা রোগীর চিকিত্সার সক্ষমতা দেশে আছে। অর্থাত্ চিকিত্সার সক্ষমতার চেয়ে বেশি করোনা রোগী এক দিনে শনাক্ত হয়েছে।
এদিকে গত দুই সপ্তাহ ধরে করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকায় বাড়ছে আইসিইউ সংকট। রাজধানীর অনেক হাপসাতালে আইসিইউ শয্যা খালি নেই। আবার কিছু সংখ্যক হাসপাতালে আইসিইউ বেড বাড়ানো হলেও আইসিইউ চালানোর জন্য যে ম্যানেজমেন্ট প্রয়োজন তা নেই। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে বিনা চিকিৎসায় রোগী মারা যাবে।
চিকিৎসাসেবায় আইসিইউ যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ, করোনা মহামারি তা সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তারপরও এক বছরেরও বেশি সময় পেলেও দেশে বাড়েনি আইসিইউ সক্ষমতা। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা কার্যকর করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী গত বছরের জুনে একনেকের বৈঠকে সারা দেশে সব জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ চালুর নির্দেশ দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হাইফ্লো অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী আইসিইউ চালানোর জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে ৪০০ জুনিয়র কনসালট্যান্ট নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও অর্ধেক জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন করা হয়নি, অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোনো অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়নি এবং ৪০০ জুনিয়র কনসালট্যান্ট এখনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, আইসিইউ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মূলত পালন করে থাকেন অ্যানেসথেসিওলজি ও ক্রিটিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা। করোনা মহামারির মধ্যে আইসিইউ বেড বাড়লেও জনবল বাড়েনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৪০০ জুনিয়র কনসালট্যান্ট নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। অথচ জনবল সংকটে বৃদ্ধি করা আইসিইউ বেডে রোগীর সেবা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। সারা দেশে প্রকৃত আইসিইউ বেড আছে চার শতাধিক। মন্ত্রণালয়ের আমলারা কী কারণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে বিলম্ব করছেন? আমলাদের মনোভাব এমন যে, মানুষ মারা যাক, তাদের কী আসে যায়। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে।
ঢাকার করোনা ডেডিকেটেড অন্যতম চার হাসপাতালেই কোনো আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ফাঁকা নেই। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ বেড খাালি নেই। এছাড়া করোনা ডেডিকেটেড কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ২৬টি আইসিইউ বেডের মধ্যে চারটি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬ বেডের মধ্যে ৯টি, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ছয় বেডের মধ্যে ছয়টি, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫ বেডের মধ্যে দুটি, জাতীয় হূদেরাগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ১০টি বেডের মধ্যে দুইটি, ২৫০ শয্যা টিবি হাসপাতালের পাঁচটি আইসিইউ বেডের মধ্যে তিনটি, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ১০টি বেডের মধ্যে চারটি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ বেডের মধ্যে তিনটি আর ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালের ২১২ আইসিইউ বেডের মধ্যে খালি রয়েছে ১২০টি।
ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, আমার এখানে শত রোগী আইসিইউতে ভর্তি। সমস্যা হলো জনবল। বহুবার বলা হয়েছে জনবল বাড়াতে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিবেকে যদি নাড়া না দেয় তাহলে কিছু করার নেই। তবে আমরা রোগী এলে ফেরত দেব না। যেটুকু পারি চিকিত্সা সেবা দিয়ে যাব। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, আইসিইউ খালি নেই। প্রতিদিনই রোগী বাড়ছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাপসাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হকও একই কথা বলেছেন।
এদিকে গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় কেবল ঢাকা জেলাতেই ৩ হাজার ১৬৫ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা মোট শনাক্তের প্রায় ৩৮ শতাংশ। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত মোট ৮ লাখ ৯৬ হাজার ৭৭০ জনের আক্রান্ত হওয়ার তথ্য এসেছে। টানা দ্বিতীয় দিনের মতো করোনায় দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা রয়েছে ১০০-এর ওপরে। গত এক দিনে সারা দেশে আরো ১০৪ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে কেবল খুলনা বিভাগেই ৩৫ জনের প্রাণ নিয়েছে এ ভাইরাস। সব মিলিয়ে দেশে করোনা ভাইরাসে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়ে ১৪ হাজার ২৭৬ জন হয়েছে। গতকাল নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার বেড়ে ২৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ হয়েছে, আগের দিন যা ২১ দশমিক ৫৯ শতাংশ ছিল। সরকারি হিসাবে গত এক দিনে আরো ৩ হাজার ৫৭০ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন ৮ লাখ ৭ হাজার ৬৭৩ জন।