মাওলানা মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ সাইফী
অনেক পরিবারের সমন্বয়ে সমাজ গঠিত হয়। তাই সমাজের অন্তর্গত পারিবারিক বলয় যত সুদৃঢ় হবে, সমাজও তত সুদৃঢ় হবে। মহানবী (সা.)-এর আচার-আচরণ, চালচলন নিজের জীবনসঙ্গিনীর সঙ্গে সহানুভূতি ও স্নেহময় ছিল। বর্ণিত আছে, ‘আয়েশা (রা.) পেয়ালার যেখানে মুখ রেখে পান করতেন, রাসুল (সা.) সেখানে মুখ রেখে পান করতেন এবং একই হাড্ডির গোশত আয়েশা (রা.) খেয়ে রাসুল (সা.)-এর হাতে দিলে রাসুল (সা.) সেখান থেকেই খেতেন, যেখান থেকে আয়েশা (রা.) খেয়েছেন।’ (নাসাঈ : হাদিস : ৭০)
সন্তান নারী-পুরুষের দৈহিক ফসল। এর একমাত্র বৈধ পথ হলো বিয়ে। ইসলাম সন্তানের পিতৃপরিচয়ের বিষয়ে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। তাই বিয়েবিহীন যৌনমিলনকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখে। তাই যারা বিয়েবিহীন যৌনমিলনে লিপ্ত হয়, তাদের জন্য ইসলাম কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না, নিশ্চয়ই তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ।’ (সুরা আল ইসরা, আয়াত : ৩২)
ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তান বৈধ হওয়ার জন্য শর্ত হলো, বৈধ বিয়ের মাধ্যমে যৌনমিলন থেকে সন্তানের জন্মগ্রহণ। এ প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘সন্তান তারই, যার সঙ্গে (বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে) ফিরাশ বা শয্যাযাপন হয়। আর ব্যভিচারকারীর জন্য রয়েছে পাথর।’ (বুখারি, হাদিস : ২০৫৩)
তাই সন্তানের বৈধ পিতৃত্বের স্বীকৃতির জন্য তার মা-বাবার বৈধ বিয়ে অপরিহার্য। এই বৈধ বিয়ের মাধ্যমে সংঘটিত মিলনের ফসল হিসেবে যে সন্তান জন্ম নেবে, তা হবে ওই পুরুষের সন্তান। কারণ যৌনমিলনের মাধ্যমে সাধারণত পুরুষের বীর্য স্ত্রীর জরায়ুতে প্রবিষ্ট হয়। আর তা থেকেই জন্ম নেয় সন্তান। এটাই প্রাচীনকাল থেকে সন্তান জন্ম দানের রীতি। আধুনিককালে অবশ্য যৌনমিলন ছাড়াও স্বামীর বীর্য স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপনের কৃত্রিম ব্যবস্থা মানুষ অবিষ্কার করেছে। বর্তমান যুগে এ কারণে যৌনমিলন ছাড়াও সন্তান জন্ম নিচ্ছে। কৃত্রিম গর্ভ সঞ্চারের নব-আবিষ্কৃত এ পদ্ধতির নাম টেস্টটিউব। এখানে টেস্টটিউব সন্তান সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি পাঠকদের সামনে পেশ করছি।
টেস্টটিউবে গর্ভ সঞ্চার করে তা মানব জরায়ুতে স্থাপন করা ইসলাম অবৈধ মনে করে না। তবে ইসলাম এ ক্ষেত্রে সে সন্তানকে বৈধ সন্তান বলে স্বীকৃতি দানের জন্য নিম্নোক্ত শর্তগুলো আরোপ করে।
১. বীর্য ও ডিম্বাণু অবশ্যই স্বামী ও স্ত্রীর কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে, অন্য কোনো পুরুষ ও নারীর কাছ থেকে বীর্য ও ডিম্বাণু সংগ্রহ করে তা দ্বারা গর্ভ সঞ্চার করা যাবে না।
২. টেস্টটিউবে সঞ্চারিত ভ্রূণ অবশ্যই স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করতে হবে, অন্য কোনো মহিলার জরায়ুতে তা স্থাপন করা যাবে না।
৩. স্বামীর বীর্য ও স্ত্রীর ডিম্বাণু নিয়ে টেস্টটিউবে গর্ভ সঞ্চারের বিষয়টি অবশ্যই স্বামীর জীবদ্দশায় হতে হবে। স্বামীর মৃত্যুর পর বীর্যব্যাংকে রক্ষিত তার বীর্য দ্বারা কিছুতেই গর্ভ সঞ্চার করা যাবে না।
এ প্রসঙ্গে বিগত ৮-১৩ সফর, ১৪০৭ হিজরি মোতাবেক ১১-১৬ অক্টোবর ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে জর্দানের রাজধানী আম্মানে অনুষ্ঠিত ওআইসির ফিকহ একাডেমির অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে—
কৃত্রিম গর্ভ সঞ্চার (টেস্টটিউব) প্রসঙ্গে পঠিত প্রবন্ধ এবং এ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদের বক্তব্য শোনা এবং সামগ্রিকভাবে এ বিষয়ে জানার পর অধিবেশনের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে বর্তমান যুগে কৃত্রিম গর্ভ সঞ্চারের সাতটি পদ্ধতি রয়েছে। অধিবেশন এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তাবলি গ্রহণ করছে—টেস্টটিউবের অবৈধ পদ্ধতি
নিম্নোক্ত পাঁচটি পদ্ধতি শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম ও সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। কারণ এর ফলে পিতৃৎপরিচয় ও মাতৃপরিচয় উভয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো ইসলামী শরিয়তবিরোধী বিষয় রয়েছে।
এক. স্বামীর কাছ থেকে সংগৃহীত বীর্য ও অন্যের স্ত্রীর কাছ থেকে সংগৃহীত ডিম্বাণুর মাধ্যমে ভ্রূণ সৃষ্টি করে পরে তা স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করা।
দুই. কোনো পরপুরুষের বীর্য এবং স্ত্রীর ডিম্বাণু নিয়ে ভ্রূণ সৃষ্টি করে পরে তা স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করা।
তিন. স্বামীর বীর্য ও স্ত্রীর ডিম্বাণু নিয়ে ভ্রূণ সৃষ্টি করে পরে তা অন্য কোনো নারীর জরায়ুতে স্থাপন করা।
চার. পরপুরুষের বীর্য ও পরস্ত্রীর ডিম্বাণু নিয়ে বাইরে (টেস্টটিউবে) ভ্রূণ সৃষ্টি করে পরে তা স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করা।
পাঁচ. স্বামীর বীর্য ও স্ত্রীর ডিম্বাণু নিয়ে তা দ্বারা বাইরে (টেস্টটিউবে) ভ্রূণ সৃষ্টি করে পরে তা স্বামীর অন্য স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করা।
টেস্টটিউবের অবৈধ পদ্ধতি
ষষ্ঠ ও সপ্তম পদ্ধতি, এ দুটি পদ্ধতি প্রয়োজনে অবলম্বন করা যেতে পারে, অবশ্য এ পদ্ধতিদ্বয় অবলম্বন করার সময় সব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। পদ্ধতি দুটি হলো—
ছয়. স্বামীর বীর্য ও স্ত্রীর ডিম্বাণু সংগ্রহ করে বাইরে টেস্টটিউবে তা দ্বারা গর্ভ সঞ্চার করে অতঃপর তা স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করা।
সাত. স্বামীর বীর্য সংগ্রহ করে তা সিরিঞ্জ দ্বারা তার স্ত্রীর জরায়ু বা ডিম্ববাহী নালিতে প্রবিষ্ট করে জরায়ুর অভ্যন্তরে গর্ভ সঞ্চার করা। (মুজাল্লাতুল মাজমা, সংখ্যা-৩, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৪২৩, সিদ্ধান্ত নম্বর-১৬ (৩/৪)
লেখকঃ- ইসলামী গভেষক ও আলোচক