স্টাফ রিপোর্টার :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেশের নারী সমাজ তাদের দক্ষতার প্রমাণ রাখতে সক্ষম হচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছি, যাতে তারা এগিয়ে যেতে পারে। কাজেই তারা যেখানেই যাচ্ছে তাদের দক্ষতার দেখাচ্ছেন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
‘প্রজন্ম হোক সমতার,সকল নারীর অধিকার’ শীর্ষক এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নিয়ে সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের মেয়েরা ভারত্তোলন থেকে শুরু করে এভারেষ্ট পর্যন্ত বিজয় করে ফেলেছে।’
তিনি বলেন, ‘খেলাধূলায় আমাদের যেসব মেয়েরা ভাল করছে তাদেরকে আমরা উৎসাহ দিচ্ছি এবং সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে যাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘মেয়েরা যে পারে সেটা আজ প্রমাণিত।’
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের হাইকোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্টে বিচারপতি পদে কখনও কোন মেয়েরা পদোন্নতি পায়নি। তবে, প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরই সে সময়কার রাষ্ট্রপতিকে বলেছিলাম, এখানে মহিলা বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে এবং সেই থেকেই শুরু আর এখন অনেক মহিলা বিচারপতি আছেন।
সরকার প্রধান বলেন, ‘শান্তিরক্ষা মিশনে আমাদের পুলিশ বাহিনীর যে কন্টিনজেন্ট কঙ্গোতে আছে, সেখানে তারা খুব ভালো করছে এবং শান্তিরক্ষা মিশনে মেয়েদের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর নারী অফিসারদেরকেই তারা চাচ্ছে। কারণ মেয়েরা সেখানে অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘এজন্য আমি সত্যিকারেই গর্বিত।’
মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।
ইউএন উইমেনের এদেশীয় প্রতিনিধি এবং ভারপ্রাপ্ত আবাসিক সমন্বয়ক শোকো ইশিকাওয়া অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন।
মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী রওশন আক্তার স্বাগত বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ‘জয়িতা পদকে’ ভূষিত সফল পাঁচজন নারীর হাতে সম্মাননা তুলে দেন।
পদক প্রাপ্তরা হলেন- আনোয়ারা বেগম, ডা. সুপর্ণা দে সিম্পু, মরহুম মমতাজ বেগম, অরনিকা মেহেরিন ঋতু এবং সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেরি অ্যান টেইলর।
অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু ও নারী উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রামাণ্য চিত্র পরিবেশিত হয়। পরে অনুষ্ঠিত মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
মন্ত্রি পরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারের পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, বিদেশি কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি, বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার প্রধান সহ বিভিন্ন নারী নেতৃবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ মজুরি-বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ এবং কর্মক্ষেত্রে বৈরী পরিবেশের প্রতিবাদকালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সুতা কারখানার একদল শ্রমজীবী নারী মালিকপক্ষের দমন-পীড়নের শিকার হন। সেইদিনের নারী আন্দোলনের স্মরণে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ও রাজনীতিবিদ ক্লারা জেটকিনের আহ্বানের মধ্যদিয়ে বিশ্বব্যাপী ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতির পিতার নির্দেশে ১৯৭৩ সাল থেকে বাংলাদেশে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘নারীরা যত শিক্ষিত হবে, নারীরা যত স্বাবলম্বী হবে সমাজ তত দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবে। কারণ সমাজের অর্ধেক অংশকে অকেজো রেখে দিয়ে একটি সমাজ সঠিকভাবে চলতে পারে না। সে সমাজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলবে।’
প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, সংসদ উপনেতা, জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা সহ বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে তাঁর সরকারের সাফল্য তুলে ধরেন তিনি।
নারীদের নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ক্ষমতা জোর করে হয় না। ক্ষমতা নিজের যোগ্যতায় অর্জন করে নিতে হয়। ক্ষমতা কেউ হাতে তুলে দেয় না। সেভাবেই আমাদের বোনদের নিজেদের তৈরি করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ধর্ষণের মত সামাজিক ব্যাধি থেকে সমাজকে রক্ষায় পুরুষদের সোচ্চার হওয়ার আহবান জানান। অন্যদিকে বাংলাদেশে নারীদের চেয়ে ছেলেরা পিছিয়ে রয়েছে উল্লেখ করে জেন্ডার গ্যাপ সমস্যার সমাধানে এর কারণ খুঁজে বের করে ব্যবস্থা গ্রহণেও সংশ্লিষ্ট মহলকে পরামর্শ দেন।
বিশ্বব্যাপী আতংক সৃষ্টিকারী করোনা ভাইরাস নিয়ে আতংকিত না হয়ে বাংলাদেশের এই সমস্যা মোকাবেলার সামর্থ রয়েছে উল্লেখ করে সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্যও পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।
সরকার প্রধান বলেন, ইদানিং নারী ধর্ষণের বিষয়টি কেবল বাংলাদেশে নয়, সমগ্র বিশ্বজুড়েই একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন,‘আমি মনে করি এখানেও আমাদের একদিকে যেমন সচেতনতা দরকার তেমনি পুরুষ শ্রেণী যারা, তাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন,‘পুরুষ সমাজের পক্ষ থেকেও আমরা চাই ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে । ’
নারীদের পাশবিক নির্যাতনকারীরা সমাজে সবচেয়ে ঘৃণিত এবং পশুর চেয়ে ও অধম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এদের বিরুদ্ধে আমাদের পুরুষ সমাজকেও ব্যবস্থা নিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দেখেছি এই বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন গণহত্যা চালিয়েছে সেই সময় মেয়েদের ওপর কী রকম পাশবিক অত্যাচার করেছিল। ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন চালাতো আর বলতো সাচ্চা পাকিস্তানী তৈরী করছে।’
জাতির পিতা এই নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিতে ভূষিত করে তাঁদের সমাজে পুণর্বাসনের উদ্যোগ নেন। নারী পূণর্বাসন বোর্ড গঠন করেন। বিদেশ থেকে চিকিৎসক এনে চিকিৎসা করান। যে সব মেয়েদের বিয়ে হচ্ছিল না, তাঁদের নিজের পরিচয়ে বিয়ের উদ্যোগ নেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন,জাতির পিতা বলেছিলেন-‘লিখে দাও বাবার নাম শেখ মুজিবুর রহমান,ঠিকানা ধানমন্ডী-৩২ নম্বর।’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘জাতির পিতা বলতেন- শুধু মেয়েদের অধিকারের কথা বললে হবে না, তাদের অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বঙ্গবন্ধু সেটাই করেছিলেন।’
তাঁর মা’ ‘বঙ্গমাতা’ (শেখ ফজিলাতুন নেছা) অনেককে নিজের গহনা পর্যন্ত দিয়ে বিয়ের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলেও যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশ পুণর্গঠনকালে বঙ্গমাতার অবদানকে স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে নারীর অধিকারের কথা রয়েছে জানিয়ে দলটির সভাপতি বলেন, ‘আমাদের দেশে একমাত্র সংগঠন আমাদের আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে নারীদের অধিকারের কথা রয়েছে। আমাদের ঘোষণাপত্রেও সমান অধিকারের কথা বলা আছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকারের বিগত ১১ বছরে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীকে সহযাত্রী করা হয়েছে।
‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়ন, ‘নারী উন্নয়নে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৩-২৫’, ‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা ২০১৩’, ‘ডিএনএ আইন’, ‘যৌতুক নিরোধ আইন’, ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ ও ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ বিধিমালা’ প্রণয়ন ছাড়াও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তাঁর সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তাঁর সরকার খেলাধূলা সহ সর্বক্ষেত্রে মেয়েদের অংশ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা, ’৯৬ পরবর্তীকালে ক্ষমতায় থাকাকালীন তাঁর সরকার প্রমিলা ফুটবল আয়োজনে দেশের বিভিন্ন জেলায় যে বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন, তা স্মরণ করিয়ে দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক জেলাতে এই খেলাই অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। কিন্তু দ্বিতীয় বার সরকারে এসে প্রাথমিক পর্যায় থেকে এই খেলা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়ায় আজকে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মেয়েরা খেলাধূলায় তাঁদের পারদর্শিতা প্রমাণ করেছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সারাবিশ্বে জেন্ডার গ্যাপ নিয়ে একটি প্রশ্ন থাকলেও বাংলাদেশে বিষয়টির উল্টো ঘটছে।
তিনি বলেন,‘আমাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা উল্টে গেছে। কারণ আমাদের এখন মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে, ছাত্রের সংখ্যা কমেছে। পাশও ছাত্রীরাই বেশি করছে এবং ফলাফলও তাঁরা ভাল করছে।’
ছেলেরা কেন পিছিয়ে আছে সেজন্য জেন্ডার গ্যাপ পূরণে তাঁকে এখন নজর দিতে হবে এবং এজন্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিক্ষামন্ত্রীকে এ বিষয়টিতে নজর দেয়ার আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী।
তাঁর সরকার মাতৃত্বকালিন ছুটি ছয় মাসে উন্নীত করেছে এবং মাতৃত্বকালীন ভাতা, ল্যাকটেটিং মাদার ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এবং স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা দিয়ে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন।
এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের কঠোর আইন প্রণয়ন এবং মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা প্রদানের উদ্যোগ তুলে ধরে এসিড সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে তাঁর সরকারের সাফল্যেরও উল্লেখ করেন সরকার প্রধান ।
‘আরেকটি সমস্যা সারা বিশ্বব্যাপী এখন চলছে- করোনাভাইরাস,’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই করোনা ভাইরাসের কারণে অনেক দেশ এখন অর্থনৈতিক ভাবেও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা কিন্তু সারাক্ষণ মনিটর করছি। কোথাও যদি কোন সমস্যা দেখা দেয়, যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি। ইনশাল্লাহ এই ধরনের সমস্যা মোকাবেলার যথেষ্ট সক্ষমতা আমাদের রয়েছে।’
করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে সবাইকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া নির্দেশনাগুলো মেনে চলার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন,‘স্বাস্থ্য সুরক্ষার নির্দেশনাগুলো সকলকে মেনে চলার অনুরোধ জানাচ্ছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই ক্ষেত্রে আমি বলবো সবাইকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে। এছাড়া,কিভাবে চলতে হবে, কিভাবে কাজ করতে হবে সেজন্য প্রতিদিনই আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।’